ছোটোগল্পের শৈলী /নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পুষ্করা’


                                               ছোটোগল্পে উপন্যাসের মতো চরিত্রের ভিড় নেই। বিরাট দর্শন আওড়ানোর অবকাশ সেখানে থাকে না। উপন্যাসের মতো সামাজিক মানুষের বিশদ বর্ণনা বা প্রতিবেশের ভূমিকা সেখানে জোড়া যায় না। গল্পের শুরুতে সংকটের কাছাকাছি অথবা ক্রমশ সংকটকে প্রকাশ করার দায় লেখকের থাকে। জটিলতা থেকে বা সরলতা থেকে জটিলতার প্রান্তে গল্পকে দ্রুততালে উপসংহারে নিয়ে যেতে হয়। কখনও কয়েকটি বাক্য তার  ইচ্ছাপূরণ করে থাকে। এগুলিকে বীজবাক্য বা কী-ওয়র্ড বলতে পারি। গল্পের এই মিতায়তন ছোটোগল্পকে উপন্যাসের চেয়ে উঁচুদরের প্রত্যক্ষতা দান করে। ব্যক্তিকথা (অ্যানেকডোট) থেকে ছোটোগল্প অন্য পথচারী। সরল, অবিশদভাবে একটি ঘটনার ছুটে চলা ব্যক্তিকথার ধর্ম। প্লটের এই সারল্য কোনো কোনো গল্পলেখক মানলেও ছোটোগল্পের প্লটরীতি বিষাদান্ত, ব্যঙ্গাত্মক হতে পারে। গল্প নানা দৃষ্টিকোণের (পয়েন্ট অব ভিউ) পরিচয় থাকে—তা কল্পকাহিনী, বাস্তবঘেঁষা কিংবা প্রকৃতিবাদী হতে পারে। লেখক গল্প শুরু করেন প্রথম বা উত্তম পুরুষে—কথক ও লেখক ক্রমশ একাকার হয়ে যেতে থাকে। কখনও গল্পও একটি বিবৃতিমূলকতার চেহারা নেয়। চেখভের চরিত্রপ্রধান গল্পে এমন ভঙ্গি বেশি। হেমিংওয়ের ‘এ ক্লীন ওয়েল লাইটেড প্লেস' গল্পে বুড়ো মাতালের কাহিনী দুজন ওয়েটার চালিয়ে গেছে, মাঝে মাঝে এদের একজনের চিন্তাও এসেছে। আবার ঘটনাপ্রধান গল্পে ঘটনার গতি ও ফলশ্রুতি মনোযোগ কাড়ে। নিরীহভাবে ঘটনাপ্রধান গল্পও ধীরে ধীরে পাঠককে তার জটিলতায় উদ্বিগ্ন করে- -লেখকের ঝোঁক কোন্ দিকে সেটা আগে-ভাগে আঁচ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সংকটের তীব্রতায় কোনো ছোটোগল্পের যবনিকা ওঠে। তীক্ষ্ণ বাদানুবাদ বা একটি চূড়ান্ত মুহূর্তে অনায়াসে এই কাজ করে দেয়। কখনও শুরুটা গায়কের আলাপের মতো তাড়াহুড়ো নেই। কিন্তু গল্পের পারানি সঠিক পারঘাটায় পৌঁছে দেয়। বিভূতিভূষণের ‘পুঁইমাচা' গল্পে বিরাট আয়োজন নেই। কিন্তু সামান্য আবেগও পাঠকের মনে সূক্ষ্ম কাঁপন জাগায়। রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্পের সমাপ্তিতে ‘চন্দরা কহিল—মরণ!' উক্তিতে পাঠকের মনোভূমি চরিত্রটির জটিলতায় আলোড়িত হয়। সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দোসর’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘স্টোভ’ গল্পে পাঠক এক অজানা বিস্ময়ের মুখোমুখি হন। তিনটি গল্পেই কমবেশি শাণিত ভাষার ব্যবহার আমাদের মনে বিস্ময়রস আনে। শুরু মধ্যাংশ, শেষাংশ নিয়ে গল্পের যে প্লট ভাবা হয় তারও হেরফের আছে। কখনও গল্পের শেষাংশ শুরুতে বলা হল, লেখক বাকিটুকু জানান শেষাংশের ভূমিকারূপে। আবার রাজনীতি আমাদের শিল্পবিচারে কাজে লাগানো হয় অনেক সময় স্থূলভাবে। পাঠকের পছন্দসই রাজনৈতিক বিশ্বাস লেখায় সামান্য ছড় টানলেই তা শিল্পের ছাড়পত্র পায় না। রাজনৈতিক বিশ্বাসকে চরিত্রের প্রত্যয় থেকে উঠে আসতে হবে। নইলে বলবার ভঙ্গি অগোছালো, কোনোভাবে বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনে নোঙর বাঁধার চেষ্টা করতে গেলে ব্যর্থতাই বাড়বে। মানিকের অজস্র ছোটোগল্পে বলার ভঙ্গি এবং প্রসঙ্গে স্বাভাবিকতা খুঁজে দেখি না বলে একটা ভ্রান্তির অবকাশ তৈরি করি। মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, গান্ধীবাদ যাই লেখককে আলোড়িত করুক না কেন, তাকে চরিত্র-প্লটের বিশ্বাসযোগ্যতা দান করতে হবে।

গদ্যের শৈলীতে যেমন অলখ নিরঞ্জনের কথা তুলেছি, তেমনি ছোটোগল্পে বলার কিছু না থাকলেও অনেকে লিখতে লিখতে লেখক হয়ে যাচ্ছেন। এরা সেই বার্তের বলা লিখিয়ে, রচক নন। সংবাদপত্রের দাক্ষিণ্য, প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা, অন্য মাধ্যমে (যেমন কবিতায়) দক্ষতা ছোটোগল্পকার করে তোলে না। এক বিশেষ বয়সের রোমান্টিক ইচ্ছাপূরণের জন্য এরা অজস্র লিখেছেন এবং লিখে চলেছেন। উপসংহারও এদের কাছে অসম্ভবের সামিল। এখানে গল্পের ভান থাকলেও সামাজিক যে মানুষটি ব্যক্তিভাবনার উৎকেন্দ্রিকতাকে সংযত করতে পারে, তার কণ্ঠরোধ করা হয়। এরা শিল্পের জন্য শিল্প বলে প্রসঙ্গহীন, সাদামাটা, প্রকরণে, ভাষার চাকচিক্যে পাঠকের মন ভোলান। উদার মানবিকতা এবং যৌবনচাঞ্চল্যের নামে, বৈজ্ঞানিক শিরোনামায় অবৈজ্ঞানিকতার প্রহসন এনে এইসব লেখক নিজেকে এবং পাঠককে বঞ্চনা করে আনন্দ পান কাঞ্চনমূল্যের প্রসাদে। এঁদের একাধিক শ্রেষ্ঠ গল্প বাজারে চালু থাকে। কিন্তু কোন্ লেখক জীবনে কটি শ্রেষ্ঠ গল্প লিখেছেন, তার বিচার নিজে নিজে করা যায় না, তা করে পাঠক এবং মহাকাল। যুগের অবিচারে, বিজ্ঞানের ধ্বংসী রূপের একান্ত চিন্তায় কিছু লেখক এত পীড়িত যে, মনে হয় আমাদের চারপাশে বিকারী (পারভার্টেড/অ্যাবনর্মাল) মানুষেরই ভীড়। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ভাসা-ভাসা অভিজ্ঞতা এদেরকে প্রসঙ্গ ও প্রকরণ—দুই সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছে। প্রসঙ্গ ও প্রকরণজ্ঞানহীন সাংবাদিক কলম যে অরূপরীতির সৃষ্টি করছে, তার মরীচিকা সার্থক ছোটোগল্প পড়ার সূত্রে কেটে যেতে পারে। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে মনে করা হল পরশুরাম-ত্রৈলোক্যনাথের সার্থক উত্তরসূরি (শ্বেত পাথরের থালা পড়ে)। কিন্তু অতি প্রজননতায় তিনিও অসার এমনকি কামনার কূপ খুঁড়ে গল্প লিখে চলেছেন।এবারে ছোটোগল্প বিচারে শৈলীর পরিচয় কী করে লাভ করতে পারি, তার বিষয়ে বলা যাক।

১. ভালো-লাগা বা আলোচ্য ছোটোগল্পটি ঠিক কীভাবে আমাদের ভালো লাগল, তার সন্ধান করা চাই। একটি চরিত্র বা ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আমাদের অভিজ্ঞতার কোন্ বিশেষ দিকটিকে স্পর্শ করল, সেটা দেখা দরকার। 

২. আলোচ্য গল্পটির জাত-বিচার (ক্লাসিফিকেশন) একটি গুরুতর প্রশ্ন। গল্পটিতে প্রকৃতি থাকতে পারে, মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি থাকতে পারে। এই উপাদানগুলোর মিশ্রণের অনুপাত ও কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। নইলে চরিত্র-ঘটনাপ্রধান, মনস্তাত্ত্বিক, রহস্যময়, প্রকৃতিপ্রধান ইত্যাদি নামকরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। 

৩. পূর্বোল্লিখিত গল্প বলার ভঙ্গিটিও লক্ষ করতে হবে। এর মধ্যে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতাকে ধরা যাবে। এর মানে এই নয় যে, গল্পের সারসংক্ষেপ করতে হবে। ভাবনির্যাসের অগ্রগতি (প্রোগ্রেসন অব্ এসেন্স) লক্ষ করতে হবে ঘটনাজালের মধ্যে। এখানে কিছু কাট-ছাঁট হতে পারে। অনেক সময় টুকরো টুকরো কাহিনী বা চরিত্রের ছিন্নকথনের মাধ্যমে একটি ছোটোগল্প গড়ে উঠতে পারে। এই ছিন্ন কথামালার সার্থকতা তাদের গোপন অবিচ্ছিন্নতায়। সেইসব ঘটনাই কাজে লাগবে, যারা ভাবনির্যাসের বহিঃরূপ। 

৪. ছোটোগল্পের গঠনশৈলী আলোচনা যেমন শিল্পরূপের হদিশ দেয়, তেমনি ছোটোগল্পের ভাষাভঙ্গি অবহেলার যোগ্য নয়। লেখকের প্রকাশমাধ্যম হল ভাষা—চরিত্র, ঘটনা, মৌলিক ভাবনা, গঠনকৌশল সবই ভাষার আশ্রয়ে প্রকাশ পায়। উপন্যাসের ভাষার পটচিত্র অনেক বড়ো। সেখানের সব ভাষা-বদলের (ল্যাংগুয়েজ শিফ্‌ট্) আলোচনা ভাষাবৈজ্ঞানিক ব্যায়াম হলেও তা ক্লান্তিকর। কখনও ভুল বুঝে লেখকের ব্যবহৃত শব্দের তালিকা প্রস্তুত করে তার অভিধানগত অর্থ এবং লেখকের ভাষাব্যবহারের পার্থক্য গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। 

বীণাকার শুধু আপনমনে বাজিয়ে চলেছেন। পৃথিবীর সার্থক গল্পগুলির মধ্যে এমন সংযোগহীনতা নেই। তবু কেন এমনটি হয়। এরও কারণ আছে—

১. প্রচল গদ্যভাষায় এইসব লেখকের অনাস্থা জন্মেছে 

২. ভাষায় একটা নিজস্বতা, চারিত্রের ছাপ ফেলার তাগিদ 

৩. ভাষাকে একটু বাঁকিয়েচুরিয়ে গদ্যের সহনক্ষমতা (টলারেন্স) পরীক্ষা 

৪. অভিনব ভাষা নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব ইত্যাদি।

কবিতায় যেমন গল্পের ঢেউ এসে লাগে, তেমনি ছোটোগল্পে কবিতার রঙ লাগা বিচিত্র নয়। রোমান্টিক মন অথবা স্রষ্টার কবি-পরিচয় ভাষাকে গদ্যের কঠোরতা থেকে আবেগ ও অনুভূতির কোমলতায় উত্তীর্ণ করে। অনেক সময় যুক্তি-তর্ক-বুদ্ধির অজস্র পক্তির চেয়ে একটি কাব্যিক পক্তি অনেক বেশি ভাবায়। তবে ভাষার এই কাব্যিকতাদান ভাবপ্রধান গল্পে মানালেও বাস্তবতার প্রখরতাকে নিরুত্তেজ করে তোলে। কাজেই কাব্যের দাবিতে নয়, গল্পের দাবিতে কাব্যিকতা যদি আসে, তা বরণীয়। সঙ্গে সঙ্গে কাব্যিকতা যদি আবেগের জলাভূমি তৈরি করে, তবে তা বর্জনীয়।

৫. শৈলী বলতে যারা একান্তভাবে ভাষারূপের বৈচিত্র্যসন্ধানে তন্ময়, তাঁদের সঙ্গে এই আলোচকের তফাত আছে। আমরা ছোটোগল্পকে একটি শিল্পকর্ম ভাবছি, যার অবয়বে (স্ট্রাকচারে) প্রসঙ্গ ও ভাষার স্থান আছে। এই স্থান-দেওয়ার প্রণালী একরকম হতে পারে না। স্রষ্টার সামনে প্রসঙ্গের সম্ভার সাজানো থাকলেও রূপের তাড়নাও থাকে। প্রসঙ্গকে প্রকরণের মাধ্যমে প্রকাশের কৌশল ভিন্ন হয়ে যায় একটি বিশেষ কারণে। তা হল লেখকের বিশ্ববীক্ষার সূত্রে। ছোটোগল্পের মিতায়তন মনে রাখলে এই বীক্ষণ খানিকটা খণ্ডিত হতে বাধ্য। কিন্তু প্রসঙ্গ বা প্রকরণের নূতনত্ব লেখকদের সামান্যত পৃথক করে। সবচেয়ে বড়ো কথা লেখকের দৃষ্টিকোণ যা দিয়ে তিনি প্রসঙ্গ ও প্রকরণের নবরূপ খোঁজেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পুষ্করা'। এটি ‘দুঃশাসন’ গল্পগ্রন্থে (১৯৫২) সংকলিত হয়েছিল। আবার ১৯৫৪-তে প্রকাশিত ‘নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্পেও স্থান পেয়েছে। গল্পটি এইরকম। গ্রামীণ মানুষকে ওলাদেবীর রাগ থেকে বাঁচাতে এক শুক্লা চতুর্দশীর রাতে তর্করত্ন শ্মশানকালীর পূজায় বসেছিলেন। এই পরিবেশ এবং প্রকৃতির ভয়ংকর রূপ লেখক অসাধারণ ভাষায় চিত্রিত করেছেন। সমস্ত গ্রাম জুড়ে পদধ্বনি, চারদিকে শ্মশানের শান্তি, নীরবতা। এরই মধ্যে তর্করত্নের শিবাভোগ প্রায় ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি জানেন যে এই ভোগদান ব্যর্থ হলে গ্রামে পুষ্করা লাগবে। রাতশেষে শিবা নয়, দেবীই নিজের হাতে ভোগ নেন। এই অলৌকিক ঘটনায় তর্করত্নের প্রণামী তিনশো থেকে পাঁচশো হয়, ভোজ্যবস্তুতে গোরুর গাড়ির অর্ধেক ভরতি হয়ে যায়। পরের দিন, কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে বাড়ি ফেরার পথে তর্করত্নের চোখে যখন দেবীর লক্ষ্মীরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন রাস্তার ওপর এক ডোমনীর মৃত্যুযন্ত্রণার ছবি লেখক ফুটিয়ে তোলেন। তর্করত্ন, কাশী কুমোর ও গ্রামবাসীরা নিজেদের বিশ্বাসে ভর দিয়ে থাকলেও লেখক জানান যে ঐ ডোমনীই শ্মশানকালীর শিবাভোগ খেয়েছিল। দীর্ঘ অনাহারের পর ঐ রাজকীয় ভোগ তাকে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে দিয়েছে। মানুষের বাঁচার কামনা এবং অন্ধ সংস্কার শ্মশানকালীর পুজোতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। কিন্তু ঐ অভাগিনী দেবাতর ভোগ পেয়েও জীবন বাঁচাতে পারেনি। সংস্কারকে অগ্রাহ্য করার শক্তি সে পেয়েছিল ক্ষুধার জ্বালা থেকে। কাহিনীটিতে মানসিক সংস্কারের মূঢ়তা যেমন একদিকে উপহসিত, অন্যদিকে যুদ্ধের সময় মানুষের চরম দুর্দশা জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে।এ তো গেল প্রসঙ্গ কথা। এবার প্রকরণবৈশিষ্ট্য বা শৈলীবৈশিষ্ট্য বিচার করা যাক :

গল্পটি পাঁচটি অনুচ্ছেদে বিভক্ত। সেগুলির পরিকল্পনা এইরকম—

ক. শ্মশানস্থলের বর্ণনা। অসময়ে কালীপূজার কারণ। শিবাভোগের সমাপ্তির জন্য তর্করত্নের কাতর প্রার্থনা। পূজার বিশদতা। শুক্লা চতুর্দশীর মধ্যরাত্রি।

খ. শ্মশানস্থল এবং জীবন্ত মানুষের শ্মশানের পাশাপাশি বর্ণনা। তর্করত্নের বিশ্বাস আর পারিপার্শ্বিকের মধ্যে বৈপরীত্যবোধ। কালীমূর্তির বীভৎসতা। তর্করত্নের পূজার নিষ্ফলতার বিচলন—তাঁর ধ্যানমূর্তি। তৃতীয় প্রহর। এরই সঙ্গে এই পূজায় তাঁর আর্থিক লাভের সম্ভাবনা আঁকা হয়েছে।

গ. কালীমূর্তির আবির্ভাব। তর্করত্নের সাধনায় সিদ্ধিলাভ। গ্রামীণ সমাজে আলোড়ন। চতুর্থ প্রহরের ঘটনা। ঘ. গ্রাম্য সমাজের প্রতিক্রিয়া। কাশী কুমোরের মিথ্যাচার (দেবীকে স্বচক্ষে দর্শন)।

ঙ. তর্করত্নের বিদায়যাত্রা। একদিকে পুষ্করা রোধে তার সফলতা, অন্যদিকে লক্ষ্মীর পুণ্যস্পর্শে গ্রামকে নূতন রূপে দেখার স্বপ্ন। মাঝে আছে ডোমনীর মুমূর্ষু শরীর। পরিণামে লেখকের আশাবাণী—মারী-মড়কের সমস্ত বিষ গ্রামীণ মানুষরা নীলকণ্ঠের মতো পান করে বলে পুষ্করা কেটে যাবে। কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধ্যা।

২. কাহিনীকাল বিচার করলে দেখতে পাই তা ঘটতে একটি পুরো দিনও লাগেনি। শুক্লা চতুর্দশীর মাঝরাত থেকে কোজাগরীর সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনাকাল বিস্তৃত। অথচ এই সংক্ষিপ্ত সময়ে বাঙালি সমাজের এক নিদারুণ ছবি আঁকা হয়ে গেল। ‘পুষ্করা’ কথাটির অর্থ অভিধানগতভাবে—কুরবার ভদ্রাতিথি ভগ্নপাদনক্ষত্রঘটিত অশুভ যোগভেদ। সেই অশুভ তিথি যাতে না আসে সেজন্য গ্রামীণ মানুষের সংঘবদ্ধ পূজাদান। দেবতার কাছে এই কল্যাণপ্রার্থনা ডোমনীর প্রসাদগ্রহণে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে বিদ্ধ হয়েছে। ক্ষুধিত মানুষ দেবতার অন্ন ভোগ করতে চায় । মৃত্যু ঘটে দেবতার হাতে নয়, অপরিমিত আহারের জন্য। একদিকে ক্ষুধার জ্বালা, অন্যদিকে দেবতার কল্যাণপ্রার্থনায় প্রসাদের থালা সমাজের দুটি অভিজ্ঞতার চিহ্ন। সমকাল ক্রিয়া করে প্রথম অংশে। দৈবানুগ্রহ লাভে তৎপরতা আমাদের হাজারো বছরের অর্জিত সংস্কাররাজ্যে নিয়ে যায়। দুটো ঘটনাই এককালে লগ্ন—ক্ষুধার তাড়নায় নিরুপায়তা এবং দেবতা সম্পর্কে সংস্কার। সংস্কারের অন্ধকার চিরে সামাজিক সত্যের যে নিষ্ঠুর আত্মপ্রকাশ আমরা দেখি, তা অমানবিক বীভৎস হলেও স্বাভাবিক।

৩. এবারে ভাষা প্রসঙ্গে আসা যাক। এই তীক্ষ্ণ সমাজসন্ধানী গল্পটির ভাষায় নাটকীয়তা আছে। নাটকীয়তা এসেছে পূজা ও পূজাস্থল, দেবীর ভোগগ্রহণে ভক্তদের প্রতিক্রিয়া বোঝাতে। এর জন্য সংলাপ অবশ্যই সাহায্যে এসেছে। সেইসব জায়গায় বক্তাদের চরিত্রের আভাস দিতে কতকগুলি বিশেষণ লেখক খুঁজে নিয়েছেন।

৪. পরিবেশ চিত্রণে আবার বর্ণনামূলক ভাষা দেখি। সেই ভাষাও পরিবেশের বীভৎসতাকে ফুটিয়ে তুলেছে :

ক. নদীর জল ‘কালো আর পিঙ্গলে মিশে যেন হিংস্রতার রূপ নিয়েছে।'

খ. ওপারের বনজঙ্গলগুলো রাশি রাশি বিচ্ছিন্ন আর আকারহীন বিভীষিকার মতো জেগে রয়েছে।

গ. তার ওপরে বড় একটা জবাফুল, পেট্রোম্যাক্সের আলোতে চাপবাঁধা খানিকটা রক্তের মতো দেখাচ্ছে। ঘ. আধপোড়া হাড়, মানুষের মাথা, চিতার কয়লা, পোড়া বাঁশ আর রাশি রাশি ভাঙা কলশি।

ঙ. বিদ্যুতের সর্পিল চমক; একটা নিষ্ঠুর রক্তাক্ত হাসির মতো

চ. বাতাসে মড়ার গন্ধ ভাসছে

ছ, মড়াখেকো শ্মশানকুকুরের একটানা কান্না

জ. একমাথা ঝাঁকড়া চুল, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, অর্ধনগ্ন নারীমূর্তি। তার দাঁতের চাপে হাড়গুলো মড় মড় করে ভেঙে যাচ্ছে।

ঝ. চারিদিকে রন্ধ্রহীন অন্ধকার, কালো অন্ধকার, পচা মড়ার গন্ধ, আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় কালো বৃষ্টি গলে পড়ছে।

ঞ. মরা নদীর জল আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল, ওপারের ন্যাড়া শিমুল গাছে ডুকরে উঠল শকুনের বাচ্চা।

এ সব উদারণ যেমন গেল দশটি বীভৎস ছবির বর্ণনা, তেমনি শান্ত রসের চিত্রণেও লেখক কার্পণ্য করেননি। যেমন :

ক. মাঠ-উজ্জ্বল চাঁদের আলোর দিকে দিগন্তে ধানের শীষ দুলছে—চমৎকার ফলন হয়েছে এবার।...পথের দুপাশে কাঠমল্লিকার ফুল যেন গন্ধের মায়া বিস্তার করে দিয়েছে।

৫. গ্রামটি অচিহ্নিত। বাংলাদেশের যে-কোনো গ্রামে এটি ঘটতে পারত। তাই উপভাষা নেই। কিন্তু ইতর দেশি শব্দে চলিত ক্রিয়ার বিন্যাসে সংলাপ, চরিত্র নির্দিষ্ট মাত্রা পেয়েছে। যেমন—পাত্তা দেখা, রাত কাবার, উচ্ছন্নে যাওয়া, যা কপালে আছে, তাই হবে; চিমসে লুচি, পোয়াটাক বোকা পাঁঠার মাংস, বয়ে যাওয়া, হারামজাদা, ঘোড়ার ডিম, শরীর হিম হওয়া, থর থর করে কাঁপা, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা, সত্যি মিথ্যের রঙ জিভ মেলে হাঁপানো ।