• ‘ভেজাল ও নকল’ প্রবন্ধে রাজশেখর বসু মূলত যে কথা বলতে চেয়েছেন, সে সম্পর্কে বিশদভাবে আলোকপাত করুন।

  • ভেজাল এবং নকল রোধের জন্য রাজশেখর বসু তাঁর প্রবন্ধে যেসব ব্যবস্থা নেবার কথা বলেছেন, সেগুলি কী-কী, বলুন ।

  • ‘ভেজাল ও নকল’ ঠিক কোন্ শ্রেণির প্রবন্ধ, বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলুন।

  • ভেজাল এবং নকলের প্রসার ও প্রাদুর্ভাবের জন্য বস্তুতপক্ষে কারা দায়ী, বিশ্লেষণ করে দেখান

  • ভেজাল-নকল রোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, রাজশেখর বসুর অনুসারে বলুন?

  • নন্দ গোয়ালা এবং শিউরাম পাঁড়ের বক্তব্য কী ছিল? সংক্ষেপে প্রতিবেদন করুন। সরকারি কর্তাদের লোকে কেন সন্দেহ করবে বলে রাজশেখর বসু মনে করেছেন ? ব্যবসায়ীরা কীভাবে তাদের দস্তুর বদলাতে বাধ্য হয় ?

  • ‘সত্যমেব জয়তে’ এই রাষ্ট্রীয় মন্ত্রের মর্যাদা হানি কী ভাবে হচ্ছে?


                                                  শিউরাম পাঁড়ের বিদ্যা কম, তার ভেজাল সহজেই বোঝা যায়, স্বাভাবিক ঘিএর মতন রং নয়, বেশী জমাট, গন্ধ অতি কম। সেকালে যখন চর্বির ভেজাল চলত তখন চেহারা আর গন্ধ খাঁটী ভয়সা ঘিএর সঙ্গে অনেকটা মিলত। আজকাল ওস্তাদ ঘি-ব্যবসায়ীরা একটু নরম ঘন তেল (hydrogenated oil) কিনে তাতে ঈষৎ হলদে রং এবং রাসায়নিক গন্ধ মিশিয়ে বেচে। ঘিএর এসেন্স বাজারে খোঁজ করলেই পাওয়া যায়। তার গন্ধ অতি তীব্র, একটু পচা ঘিএর মতন এক সেরে কয়েক ফোঁটা দিলেই সাধারণ ক্রেতাকে ঠকানো যায়। সরষের তেলের এসেন্স আরও ভাল, রাই সরষের মতন প্রচণ্ড ঝাঁজ। চীনাবাদাম তিল তিসি—যে তেল যখন সস্তা, তাতে অতি অল্প এসেন্স দিলেই কাজ চলে। যাদের সাহস বেশী তারা আরও সস্তায় সারে, অপাচ্য প্যারাফিন বা মিনার অয়েলে অল্প গন্ধ দিয়ে বেচে। সরষের সঙ্গে শেয়ালকাঁটা বীজের মিশ্রণ সম্ভবত ইচ্ছাকৃত নয়।চায়ের দোকানে এবং হোটেলে যে চায়ের ছিবড়ে জমা হয় তা শুকিয়ে অন্য চায়ের সঙ্গে ভেজাল দেওয়া হয়। এলাচ লবঙ্গ দারচিনি থেকে অল্পাধিক আরক (essential oil) বার করে নেবার পর বাজারে ছাড়া হয়। সব চেয়ে বেশী ভেজাল আর নকল চলছে ঔষধে। কুইনিন এমেটিন আড্রেনালিন প্রভৃতির লেবেল দেওয়া জাল ঔষুধে বাজার ছেয়ে গেছে। শিশি-বোতল-ওয়ালারা বিখ্যাত দেশী ও বিলাতী ঔষধ এবং প্রসাধন দ্রব্যের খালি শিশি ও টিন বেশী দাম দিয়ে গৃহস্থের বাড়ি থেকে কেনে, জালকারী তাতেই ছাইভস্ম পুরে বিক্রি করে। অনেক গৃহস্থ জেনে শুনে এই পাপ ব্যবসায়ে সাহায্য করে। পাকিস্তানেও এই কারবার অবাধে চলছে।গোয়ালা দুধে জল মেশায়। প্রাবন্ধিকের আপত্তিতে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে নিজের দোষ স্বীকার করে বলে যে, একটু অতিরিক্ত লাভের আশায় সে এই কাজ করে। প্রাবন্ধিকের উৎসাহে সে এই তথ্যও জানায় যে শুধু গোয়ালারাই নয়, নামকরা ডেয়ারি খাঁটি দুধ বলে যা বিক্রি করে, তা আসলে মোষের দুধে জল মেশানো দুধ।বাড়ীর প্রাক্তন রান্নার ঠাকুর শিউরাম পাঁড়ে একদিন ঘি বিক্রি করতে এলে ঘি দেখে প্রাবন্ধিকের সন্দেহ হয় যে এতে ভেজাল আছে কারণ ঘি খুব সাদা, শক্ত ও একটু গন্ধযুক্ত। সন্দেহ প্রকাশ করলে শিউরাম অস্বীকার করলেও পরে বলে সে এবং গোয়ালা মিলিয়ে এক সেরে (কিলো) দেড় পোয়া (১ পোয়া = ২৫০ গ্রাম) মিশিয়েছে। প্রাবন্ধিকের সন্দেহ সেরে তিন পোয়ার বেশী ভেজাল আছে। এই রকম ভেজাল ঘি প্রাবন্ধিক নিজেই বানানোর প্রস্তাব দিলে লজ্জায় শিউচরণ আপত্তি জানায়। দুধ-ঘি এর কালোবাজার না থাকায় ভেজাল দিয়েই লাভ করতে হয়। শিউরাম পাঁড়েদের বুদ্ধি কম বলে তাদের ঘি দেখলে ভেজাল বোঝা যায়, কিন্তু যারা বড় ঘি ব্যবসায়ী তারা নরম ঘন তেল (hydrogenated oil) এর সঙ্গে কিছুটা হলুদ রং ও ঘি এর এসেন্স মিশিয়ে ঘি বলে বিক্রি করে। বাদাম, তিসি ইত্যাদি সস্তা তেল, আবার কখনো প্যারাফিন বা মিনারেল অয়েলের সঙ্গে ও এসেন্স দিয়ে সর্ষের তেল বলে বিক্রি করা হয়। রাজশেখর বসুর ‘ভেজাল ও নকল' প্রবন্ধটি, তাঁর যে তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ আছে, তার মধ্যে ‘বিচিন্তা’ প্রবন্ধগ্রন্থের অন্তর্গত। এই প্রবন্ধটি প্রাবন্ধিক ১৩৫৭ বঙ্গাব্দে রচনা করেন। এই প্রবন্ধে তাঁর মূল বক্তব্য চারটি। 

(এক) আমাদের প্রতিদিনের নানা রকম খাদ্যে নানা ভেজাল মেশানো হয়। যা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। 

(দুই) এই খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকারী বেসরকারী দুই পক্ষেরই গাফিলতি আছে। 

(তিন) এই ভেজাল প্রতিরোধে যে যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। 

(চার) ভেজাল যতদিন আটকানো না যাচ্ছে ততদিনের বিকল্প ব্যবস্থা।

প্রবন্ধের প্রথম অংশে খাদ্যে ভেজালের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি দুধের উদাহরণ দিয়ে শুরু করেছেন। তাঁর মতে দুধের নকল না থাকায় লাভ করার জন্য ব্যবসায়ীর দুধে ভেজাল হিসেবে জল মেশায়, যা দুধের খাঁটিত্ব হয়ত নষ্ট করে কিন্তু এতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা কম। আগে ঘিতে ভেজাল হিসেবে চর্বি মেশানো হত। কিন্তু এখন বড় ব্যবসায়ীরা ঘি বলে যা বিক্রি করে তাতে ঘি থাকেই না। নরম ঘন তেল (hydrogenated oil) এর মধ্যে হলুদ রং ও ঘি এর গন্ধ মিশিয়ে বিক্রি করে। সর্ষের তেলের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি যে কোনো সস্তা তেলের মধ্যে গন্ধ মিশিয়ে সর্ষের তেল বলে বিক্রি করা হয়। কেউ কেউ আবার অপাচ্য প্যারাফিন বা মিনারল অয়েলের মধ্যে গন্ধ মিশিয়ে সর্ষের তেল বলে বিক্রি করে। শুধু দুধ-ঘি-তেল নয়, ময়দা-আটা থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত সমস্ত কিছুতেই নানা মাত্রায় ভেজাল মেশানো হয়। রেশনের ময়দা বেলবার সময় রবারের মত টান হয়। আটায় প্রচুর পরিমাণে ভূসি থাকে গম-যব ছাড়া অন্য শস্যের বলেই মনে হয়। আটার কলে ভেজাল হিসেবে সোপ স্টোন বা তেঁতুল বিচিও পাওয়া গেছে। চালে ভেজাল হিসেবে পাথরকুচি মেশানো হয়। অসময়ে বাজারে যে সবুজ মটরশুঁটির দানা বিক্রি হয়, তা আসলে শুকনো মটর বস্তাবন্দী করে সবুজ রঙে ছুপানো। এতে যে রং মেশানো থাকে তা বিষ কিনা কেউ ভাবে না। মিষ্টিতেও নানারকম রং মেশানো হয়। চায়ের দোকানে অব্যবহৃত চায়ের সঙ্গে ব্যবহৃত চায়ের গুঁড়ো ভেজাল হিসেবে মেশানো হয়। এলাচ-লবঙ্গ-দারচিনি থেকে কিছুটা আরক বের করে নিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য ছাড়া হয়। তবু সব থেকে বেশী খারাপ অবস্থা ওষুধের। জাল ওষুধে বাজার ছেয়ে গেছে।

প্রবন্ধের শেষ অংশে যতদিন ভেজাল আটকানো না যাচ্ছে, ততদিন বিকল্প কি করা যেতে পারে তা নিয়ে প্রাবন্ধিক আলোচনা করেছেন, তাঁর মতে যতদিন না ভেজালহীন খাবার পাওয়া যায়, ততদিন তুলনায় নিকৃষ্ট ও অনভ্যস্ত খাবারই খাওয়া উচিত। জনগণের মধ্যে এই বোধ সঞ্চারিত করার জন্য একদিকে যারা ধনী ও জ্ঞানী তাদের কর্তব্য তাঁরা যাতে ও ধরণের খাবার খেয়ে সাধারণকে উৎসাহ দেন, আর সরকারের উচিত অত্যুক্তি না করে বা মিথ্যা না বলে এ ধরনের খাদ্যের উপযোগিতা প্রচার করা। এ ধরনের খাবারের মধ্যে প্রাবন্ধিক লাল আলু, টাপিওকা প্রভৃতির নাম করেছেন। এ সব অনভ্যস্ত খাদ্যে চাল-আটার সমান পুষ্টি না থাকলেও এসব খাদ্যে জীবন রক্ষাও হয়, স্বাস্থ্যহানিও ঘটে না। কিন্তু সমস্যা হল অত্যুক্তি আর মিথ্যা প্রচারের। যেমন একজন খাদ্যবিশারদ প্রচার করেছিলেন যে ঘাস থেকে সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য তৈরি হবে। সরকারের উচিত একদিকে এসব প্রচারে প্রশ্রয় না দেওয়া অন্যদিকে নিজেদের প্রচারেও অত্যুক্তি না  করা। সরকারী খবরেও প্রকাশিত হয়েছে যে ভুট্টা, টাপিওকা ইত্যাদি থেকে সিন্থেটিক চাল তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ প্রচার অসত্য। রাসায়নিক দ্রব্য কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা সম্ভব হলেও শস্য তৈরি বিজ্ঞানের অসাধ্য। যে জিনিস তৈরি হচ্ছে তাকে নকল চাল বলা উচিত। নকল সোনা যেমন আসল সোনার মত দেখতে হওয়ায় অনেকে কেনে। তেমনি এ জিনিস চালের মত দেখতে হলে দরিদ্র মানুষ হয়ত কিনবে, কিন্তু এর পুষ্টি কখনো আসল চালের সমান হবে না। সরকারের উচিত প্রচারের ব্যাপারে যাতে কোনো অসতর্ক উক্তি না হয়, ‘সত্যমেব জয়তে’ রাষ্ট্রীয় মন্ত্রকে রাষ্ট্রেরই মনে রাখা উচিত।

প্রাবন্ধিক রাজশেখর বসু অত্যন্ত সহজ চলিত বাংলায় এই প্রবন্ধটি রচনা করেছেন। তাঁর বেশীর ভাগ প্রবন্ধের মত এটিও প্রয়োজনমূলক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কালোবাজারী-ভেজাল সমস্যা যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল সেই প্রেক্ষিতে তাঁর রচিত এই প্রবন্ধ। সমস্যার শুরু আগেই। স্বাধীনতার আগেই আওয়াজ উঠেছিল দেশ স্বাধীন হলে সমস্ত কালোবাজারীদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানো হবে। কিন্তু দেখা গেল সমস্যা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সে কারণে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ। এ সমস্যা যে কত ভয়াবহ তা আমরা স্বাধীনতার চার দশক পরে প্রত্যক্ষ করেছি ভেজাল তেল খেয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। ফলে তিনি জাজ্বল্যমান সামাজিক সমস্যা নিয়ে জনগণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে কলম ধরেছেন। তবে তৎকালীন বামপন্থীদের সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ণ ঠিক নয়। সে সময়ে বামপন্থীদের আন্দোলনের একটি বড় বিষয়ই ছিল ভেজাল কালোবাজারী। আন্দোলনের ময়দানে, গানে, কবিতায়, নাটকে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বামপন্থীদের এ বিষয়ে সরব হতে দেখা যায়। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনাস্থার কারণে হয়তো বামপন্থীদের সম্পর্কে তাঁর এ মূল্যায়ন। সামাজিক সমস্যাবলী নিয়ে এই ধরণের কার্যকরী প্রবন্ধ অন্নদাশঙ্কর রায়ও অনেক লিখেছেন। এসমস্ত প্রবন্ধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রাবন্ধিকের যৌক্তিকতাবোধ ও নীতিরোধের শানিত তীক্ষ্ণতা। রাষ্ট্রীয় মন্ত্রকে স্মরণে রাখতে বলার নেপথ্যে কাজ করছে প্রবল দেশপ্রেমের বোধ। কল্যাণমূলক ও সত্যকামী রাষ্ট্রের মানবিক মুখ স্বাধীনোত্তর অনেক প্রাবন্ধিকের কলমেও ফুটে উঠেছিল পরবর্তীকালে। সামাজিক জীবনে সংস্কারমূলক চিন্তাচেতনার প্রকাশ রাজশেখর বসুর মতন বিজ্ঞাননিষ্ঠ, কর্মনিষ্ঠ, স্বাধীন ও স্বয়ম্ভরতার প্রচারকের লেখাতেও ঘটেছে। সমস্যা সমাধানের কোন নৈরাজ্যকামী আন্দোলনে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। ট্রাম-বাস পোড়ানোর আন্দোলনের ঝোঁক সম্পর্কে সচেতনভাবে সমালোচনা করেছেন। সর্বোপরি রাজশেখর বসুর রচনার মধ্যে একটা statesmanship ছিল যার প্রকাশ প্রবন্ধগুলির স্থিতধী ও শানিত প্রকাশভঙ্গী।