যুক্তির গদ্য, সৃষ্টি গদ্য
যুক্তির গদ্যে প্রার্থিত হল—সংক্ষিপ্ততা, ভারসাম্য, নিয়মানুগত্য এবং বিষয়ানুবদ্ধতা। অন্যদিকে সৃষ্টির গদ্যে যুক্তির গদ্যের গুণগুলিকে চরম বলে ধরা হয় না। আবার যুক্তির গদ্যেও সৃষ্টির স্থান আছে। কেননা একজন সচেতন সামাজিক মানুষই যুক্তির গদ্য লেখে। সৃষ্টির গদ্যে বিষয় শুধু জ্ঞানজগৎ নয়, মানবচরিত্র। কাজেই অনুভূতির দোলাচল আঁকতে গিয়ে লেখকরা যুক্তির সোপান, ব্যাকরণের নিয়মকে লঙ্ঘন করেন। আমরা পাঠকরা তাই উপন্যাস, গল্প, নাটকে গদ্যের শরীর দেখি না—খুঁজি তার প্রতিক্রিয়াকে। কেননা রসিকের চিন্তা : সৃষ্টি গদ্য ভাবতে গেলে যদি সৃষ্টিটাই হারিয়ে যায়। অথচ প্রাবন্ধিকের গদ্যে যুক্তি-তর্কের শিকলি যেমন তার বোধ-বোধির ফল, তেমনি সৃষ্টির গদ্যেও ভালো করে লক্ষ করলে সাহিত্যিকের মনের খবর জানা যায়। সাহিত্যিক গদ্যকে নিজের প্রয়োজনে ভাঙচুর করেন, আর একান্ত যুক্তির গদ্যকার বন্ধন মেনেই নিজের বক্তব্যকে হাজির করেন।একটি উপন্যাসের শৈলী বিচারে তার পরিবেশ, সমাজ তত্ত্ব, বিশেষ শ্রেণীচেতনা, অভিজ্ঞতা যতটা সক্রিয়, যুক্তির গদ্যে তার সুযোগ কম। কেননা যুক্তির গদ্য লেখা হয় কয়েকটি কারণকে কেন্দ্র করে—
১. নূতন তত্ত্বের উপস্থাপনা
২. বিজ্ঞান-বাণিজ্য বিষয় প্রচার
৩. নিজের জ্ঞানমূলক অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা
৪. ইতিহাস, ভূগোলাদির পরিচয়
৫. কোনো সামাজিক বা অন্য বিতর্কের সৃষ্টি
৬. ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থের অভাব
৭. ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি তাত্ত্বিক বিষয়ের জটিলতা ভঙ্গ
৮. মাতৃভাষার প্রকাশক্ষমতা পরীক্ষা
৯. সৃষ্টির গদ্যের ব্যাখ্যা
১০. সৃষ্টির গদ্যে প্রকাশের অযোগ্য বিষয়ের জন্য
এই দশটি কারণ এসেছে লেখকের মনের গড়ন, যুগের দাবি কিংবা সামাজিক উপযোগিতাকে নির্ভর করে। যুক্তি ও সৃষ্টি—গদ্যের এই দোরাস্তার প্রথমটির ইতিহাসক্রম জানতে পারি। সৃষ্টির গদ্য নিয়ে আমরা নীরবতা হিরণ্ময় মনে করি। গদ্যশৈলী দেখতে গিয়ে. কারোর ক্ষেত্রে স্বদেশি বা বিদেশি প্রভাব লক্ষ করি ও বলি, বিদ্যাসাগর সংস্কৃতানুসারী, প্রমথ চৌধুরী ফরাসিস কিংবা সুধীন্দ্রনাথ জর্মন রীতির গদ্য লিখতেন। এই বলার পেছনে এঁদের পড়াশোনার পরিধি বা ভালো-লাগা সাহিত্যবোধ সক্রিয় ছিল। অথচ ফরাসি বা জর্মন রীতির গদ্য বাংলায় এলে তা কতদূর বাংলা হবে, এ কথা ভাবি না। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃতানুসারিতার লেবেল পাওয়ার কারণ তাঁর শৈলীতে তৎসম শব্দ বা সমাজের প্রভাব। কোনো সমালোচকই পাশাপাশি সংস্কৃত, ফরাসি, জর্মন গদ্যশৈলীর নমুনা দেখাননি।
১. উপলক্ষ্য বর্গীকরণ (কনটেক্সচুয়াল ক্লাসিফিকেশন) : একটি কৃতির উপলক্ষ্য নির্দেশ করে আমরা সেখানে কী ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তা দেখতে পারি। যেমন উনিশ শতকের সাধারণ গদ্য এবং ‘শকুন্তলা’। আবার উলটোভাবেও এটি করা যায়। যেমন, উনিশ শতকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ব্যবহারের একটি বিশেষত্ব উদ্ধার করা এবং তাকে ‘প্রাচীন' নামে চিহ্নিত করা। বাস্তবে আমরা দুটো পদ্ধতিই প্রয়োগ করে থাকি। আসলে উপলক্ষ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখতে হবে, কোন্গুলি শৈলীবিজ্ঞানের দিক থেকে সংগতিপূর্ণ, আর কোন্গুলি অতিরেক (রিডানডেন্ট)। এখানে সব মিলিয়ে সাধারণ যে রূপটি স্পষ্ট হয় তা হল আবরণ (এনভেলাপ), আর উপলক্ষ্য হল শৈলীবিজ্ঞানের সংগতিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ।
১. যথার্থ ঐতিহাসিক ও ঔপভাষিক পরিবেশে কৃতির উপস্থাপনা
২. ক্ষেত্র, ধরন এবং সংশ্লেষণের সম্পর্ক দ্বারা কৃতির বিশ্লেষণ
গদ্যের শৈলীবিচারের মানক গদ্যের শৈলীবিচার করতে গিয়ে কতকগুলি মানক স্থির করা প্রয়োজন। এগুলি হল—
বাক্যের প্রকৃতি
সম্পূর্ণ
অগঠিত
বাক্য
অসম্পূর্ণ
সুগঠিত
উপলক্ষ্যের সুসংগতি (কনটেক্সচুয়াল কোহেশন) : একই উপলক্ষ্যের বৈশিষ্ট্য যা বাক্যের মধ্য দিয়ে অনুভব করা যায়।
৩. শাব্দিক সুসংগতি (লেক্সিকাল কোহেশন) : একই জাতের শব্দভাণ্ডারের প্রয়োগ একটা ঐক্যভাব জাগিয়ে তোলে।
৪. উপবাক্যের সংযোগ (ক্লজাল লিংকজে) : কিছু কৌশল যা দিয়ে বাক্য, উপবাক্য কিংবা কৃতিতে বাক্যের মিশ্রণ-প্রক্রিয়া বোঝানো হয়। ‘বাক্য-উপবাক্যের সম্পর্ক ব্যাকরণে থাকলেও কৃতির সঙ্গে বাক্যের সম্পর্ক আলোচনার দাবি করে। লুই. টি. মিলিচ তাঁর ‘স্টাইলিস্টস অন স্টাইল : আ হ্যান্ডবুক উইথ সিলেকশন ফর অ্যানালিসিস'-এ বাক্যের সঙ্গে বাক্যের যোগকে আটটি মৌলিক ও যৌক্তিকভাবে দেখিয়েছেন :
ক. অতিরিক্ত (অ্যাডিটিভ) : একটি বিবৃতি যার সঙ্গে আগের বিবৃতির যোগ নেই (এবং)
খ. সূচনা (ইনট্রুডাকশন) : অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যের গড়ন
গ. বৈপরীত্যসূচক (অ্যাডভার্সেটিভ) : একটি বিবৃতি যা যুক্তির মোড় ফেরায় (কিন্তু)
ঘ. পরিবর্তিত (অলটারনেটিভ) : আগের বিবৃতির বদলে (বা, কিংবা
ঙ. ব্যাখ্যামূলক (এক্সপ্লেনেটরি) : আগের বিবৃতি নিয়ে আবার মন্তব্য, সংজ্ঞাদান বা বিশদীকরণ (তা হল)
চ. উদাহরণমূলক (ইলাসট্রেটিভ) : উদাহরণ বা ব্যাখ্যা (যেমন, উদাহরণস্বরূপ)
ছ. সূত্রমূলক (ইলেটিভ) : উপসংহার ধরনের (সুতরাং)
জ. কারণাত্মক (কজাল) : আগের উপসংহারের হেতু (কারণ, জন্য )
Social Plugin