• আমাদের মানসিকতার উপরে রূপকথা কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে বলে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেছেন, আলোচনা করুন ?

  • রূপকথার বিরুদ্ধে কী-কী অভিযোগ ওঠে? কেন? এগুলি কতখানি গ্রহণযোগ্য, বিচার করুন।

  • শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রূপকথা সম্পর্কে যে তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করেছেন, তার বিশ্লেষণ করুন ?

  • রূপকথার সৌন্দর্যসম্ভার কার জন্যে? সংক্ষেপে আলোচনা করুন।

  • রূপকথা কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল ?


আমাদের দেশ—ভারতবর্ষ এবং বিশেষ করে আমাদের প্রদেশ বঙ্গভূমি লোকসাহিত্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সত্যকার বিদগ্ধ ও যথার্থ পণ্ডিত ব্যক্তির সামনে গবেষণার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে এই একটি।বাংলা গল্পটি সংগ্রহ করেছিলেন বাংলা ব্যাকরণ রচয়িতা হ্যালেড (বা হ্যালহেড) ১৮০০ খৃষ্টাব্দের আগে। তাঁর লেখা কাগজপত্র ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। সুতরাং ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে গল্পটি বাংলা লৌকিক গল্পের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রহণযোগ্য নিদর্শন। হ্যালেডের কাগজপত্র থেকে টুকে নিয়ে পুণ্যশ্লোক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় (১৩২৮)। গল্পটি হয়ত অনেকেরই পড়া আছে। তবুও বলতে হচ্ছে আলোচনায় সুবিধার জন্যে। গল্পটি ভোজ-বিক্রমাদিত্য গল্পমালার (saga) মত গড়া। তাল-বেতাল  থাকলেও বেতাল পঞ্চবিংশতির মতো আগাগোড়া নয়। সংস্কৃত অথবা অন্য কোন ভারতীয় আর্য-ভাষায় গল্পটি মিলেছে বলে আমার জানা নেই। তবে কাহিনীর মধ্যে বিশিষ্ট বাঙালীত্ব অথবা বাংলা ঢঙ কিছু নেই।ব্যক্তি মানুষের স্মৃতির মত মানবগোষ্ঠীর ও স্মৃতি আছে। ইতিহাস-পুরাণ প্রভৃতির মধ্যে থাকে ব্যক্তিমানুষের স্মৃতির পর্যালোচনা। মানবগোষ্ঠীর স্মৃতি জমা থাকে লোকসাহিত্যে, ব্যক্তিমানুষের স্মৃতি সঞ্চিত থাকে লিখিত সাহিত্যে আর মানব গোষ্ঠীর স্মৃতি জমা থাকে মৌখিক সাহিত্যে। বিদেশী পন্ডিতেরা এইসব লৌকিক গল্পের গিঁট খুলে ইতিহাসের নাগালের বাইরের প্রাক্ ও প্রত্ন ইতিহাস কিছু কিছু খুঁজে পেয়েছেন। সাধারণভাবে ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলায় লোকসাহিত্যের যে সমৃদ্ধি সেখানে যথার্থ পণ্ডিত মানুষের কাছে এই ধরণের গবেষণার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র পড়ে আছে। একটি বাংলা ও দুটি জার্মান মোট তিনটি লোকগল্প নিয়ে আলোচনা করলে দেখানো যাবে যে, গল্প তিনটিতে কোনো এক সুদূর কাল থেকে একই মানবগোষ্ঠীর স্মৃতি বয়ে এসেছে।

ভোজপুরের রাজার ষোল বছরের সুন্দরী অ-বিবাহিতা মেয়ে মৌনব্রত পালন করেছে, তার প্রতিজ্ঞা এই যে, যে তাকে এক রাত ধরে চেষ্টা করে কথা বলাতে পারবে তাকে সে বিয়ে করবে। রাজা ভোজের আমন্ত্রণে বহু রাজপুত্র এলেও তারা বিফল হয়। শেষে রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁর দুই অদৃশ্য পোষা ভূত, তাল-বেতালকে সঙ্গে নিয়ে রাজকন্যাকে হাসাতে আসে। এক ভূত আশ্রয় নেয় রাজকন্যার খাটে, আরেক ভূত আশ্রয় নেয় রাজকন্যার গায়ের কাপড়ে। এরপর বিক্রমাদিত্য খাটের ভূতকে উদ্দেশ্য করে একটি গল্প বললেন ও গল্পের শেষে একটি প্রশ্ন করলেন । ভূতের উত্তর মনঃপূত না হওয়ায় বিরক্ত হয়ে রাজকন্যা খাট থেকে মাটিতে নেমে এলেন কিন্তু মৌনতা ভাঙলেন না। রাজা দ্বিতীয় আরেকটি গল্প রাজকন্যার কাপড়ের ভূতকে উদ্দেশ্য করে বললেন ও গল্প শেষে প্রশ্ন করলেন। এবারও উত্তর শুনে রাজকন্যার রাগ হল। কিন্তু গায়ের কাপড় খুলতে হবে একথা ভেবেই সে হেসে উঠল, আর রাজা অমনি বলল “এই তো মুখ খুলেছে' পরদিন দুজনের বিয়ে হল।

জার্মান গল্পটি এরকম- -এক রাজদম্পতির জন্মাবধি ভূতগ্রস্থ কন্যা চোদ্দ বছর বয়সে মারা গেলে পরে তার মৃতদেহ কফিনে পুরে রাজবাড়ী সংলগ্ন গির্জা ঘরে রাখা হয় ও রাত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু দেখা যায় ভূতগ্রস্ত মেয়েটি প্রতি রাতে কফিন থেকে বেরিয়ে প্রহরারত সৈনিককে মেরে ফেলে। একদিন এক তরুণ দক্ষ সৈনিকের পাহারার ভার পরে। সে কি করবে চিন্তা করতে করতে বনে গিয়ে এক বৃদ্ধকে দেখে। বনবাসী বৃদ্ধ তাকে মন্ত্রমূত বস্ত্র ও মন্ত্রপূত খড়ি দেয়, যার সাহায্যে রাতে সৈনিক ভূতগ্রস্ত রাজকন্যার সামনে অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারে ও বেঁচে যায়, এই ভাবে পরের রাতেও বৃদ্ধের সহায়তায় সৈনিক বেঁচে যায় তৃতীয় রাতে বৃদ্ধের পরামর্শে ভূতগ্রস্ত কন্যা থেকে বেরিয়ে এলে সৈনিক ঐ কফিনে ঢুকে পড়ে ও রাজকন্যার তর্জনী কামড়ে দেয়। এর ফলে রাজকন্যা ভূতমুক্ত হয় ও রাজা খুশী হয়ে দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন।

এই দুটি গল্প বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে গল্প দুটির মধ্যে গভীর মিল আছে। বাংলা গল্পটিকে ‘ক’ও জার্মান গল্পটিকে ‘খ’ ধরলে দেখানো যায়—

এক) ‘ক’ ও ‘খ’ গল্পের দুই রাজকন্যার মধ্যেই মৌনতার মিল আছে। একজন রাতে মৌন থাকে বলে, অপরজন মৃত বলে। ‘খ’ গল্পে রাজকন্যা মৃত। ‘ক’ গল্পের রাজকন্যা রাতে মৃতবৎ। দুটি গল্পের শয্যাধারই দুষ্টশক্তিসম্পন্ন। ‘খ’ গল্পে দুষ্টশক্তি রাজকন্যাকে আয়ত্ত করেছিল। ‘ক’ গল্পে এই শক্তি বিক্রমাদিত্যের সহকারী।

দুই) ‘ক’ গল্পে মৌনী কন্যা মুখ খুলতেই তুক ভেঙ্গে গেছে। ‘খ’ গল্পে সৈনিক মুখ খুলে কামড়াতেই তুক ভেঙ্গে গেছে। অর্থাৎ দুটি গল্পে ‘মুখ খোলা’ মোটিফের ভাসা ভাসা মিল আছে।

তিন) দুটি গল্পেরই নায়কের অসমসাহস। একজনকে শক্তি দিয়েছে নিজের বুদ্ধি ও পোষা ভূত, অপরকে বনবাসী বৃদ্ধ।

সোনার হাঁস নামে গ্রীম ভাইদের সংগৃহীত আরেকটি গল্প আছে। আলোচনা করলে দেখা যাবে ‘ক’ গল্পের সঙ্গে এই গল্পের মিল আছে। মিলটি হল ‘হাসি-সমাধান' মোটিফ।

‘ক’ গল্পের সঙ্গে এই গল্পের হাসির মোটিফ মিল, আর ‘খ’ গল্পের সঙ্গে মিল এই যে, উভয় ক্ষেত্রেই পাত্রকে শক্তি দিয়েছে বনবাসী ব্যক্তি। তিনটি গল্পের শ্রেণী আলাদা । ‘ক’গল্প বুদ্ধিদীপ্ত হাসিখুশী শ্রেণীর। ‘খ’ ভয়ভক্তি দৈবশক্তির ‘গ’ সরলচিত্তের দৈবপ্রসন্নতার।

‘খ’ গল্পের কফিন ও শবাচ্ছাদান বস্ত্র ভারতবর্ষের আচরণ ধারা অনুসারে ‘ক’ গল্পে রাজকন্যার খাট ও পরিহিত বস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এর ফলেই দুটি কৌতুক শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। প্রথমে এটি ভয়-ভক্তি-ভূত-দৈবশক্তি শ্রেণিভুক্ত ছিল । যেমন, “খ” গল্পে রাজকন্যাকে রক্তপায়ী ভূত আশ্রয় করেছিল। সেই ভূত রাতে পাহারাদারের মুণ্ডু ছিঁড়ে নিত। তেমনি ‘ক’ গল্পে ও হয়ত অকৃতার্থ পাত্রকে সকালে কোতল করা হত, যা গল্পে উহ্য থেকে ভালোই হয়েছে।

লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এবং মানব সভ্যতার বিবর্তনের ধারাকে উপলব্ধি করার পক্ষে এক প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে হাজির হল । প্রাবন্ধিক সুকুমার সেনও সাধারনভাবে ভারতবর্ষের বিশেষ করে বাংলাদেশের লোকসাহিত্য নিয়ে এই ধরনের গবেষণা হবে আশা প্রকাশ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি হ্যালহেড সংগৃহীত একটি বাংলা লোকগল্প ও দুটি জার্মান লোকগল্প, একটি হেড্‌উইগ সুরমান, ও অন্যটি গ্রীস ভাইদের (জেকব ল্যুডউইগ কার্ল গ্রিম (১৭৮৫-১৮৬৩), উইলল্সে কার্ল গ্রিম (১৭৮৬-১৮৫৯) সংগৃহীত, মোট তিনটি গল্পের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন। গল্পগুলির শ্রেণীবিশ্লেষণ করেছেন ও গল্পগুলির মধ্যে কোন্ কোন্ মোটিফে মিল আছে তা দেখিয়ে দেন।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লোককথা সংগ্রহের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লোককথা বিশ্লেষণের পদ্ধতি, তত্ত্ব ও নানারকম মতবাদ তৈরী হয়। ১৮৩৫ খ্রীঃ জেকব ল্যুডউইগ কার্ল গ্রিম একটি গ্রন্থ প্রকাশ করলেন 'Deutsche Mythopagic', এখানে জেকবের মননশীল আলোচনার ফলে তাকে ‘লোকসংস্কৃতি বিজ্ঞানের জনক' বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন লোকসংস্কৃতিবিদ লোককথার পদ্ধতিগত আলোচনা করেছেন। লোককথা বিশ্লেষণের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি হল—ক) তুলনামূলক পদ্ধতি : এই পদ্ধতির জনক গ্রিম ভাইরা হলেও পরবর্তীকালে ম্যাক্স ম্যুলার বা থিওডোর বেনফেও এই পদ্ধতিতে লোককথার বিশ্লেষণ করেন।

খ) ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পদ্ধতি : ফিনল্যান্ডের দুই লোকসংস্কৃতিবিদ্ জুলিয়াস ক্লোন ও তাঁরপুত্র কার্লে কোন এই পদ্ধতির স্রষ্টা। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেও অসংখ্য লোককথার ইতিহাস ও কালানুক্রমিক ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভভব হয়েছে।

গ) মনঃসমীক্ষাগত পদ্ধতি : মূলতঃ সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞান তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে কার্ল আব্রাহাম লোককথায় এই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটান

ঘ) ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতি : মার্কস—এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ধারনার ওপর নির্ভর করে জর্জ টমসন, আনর্ঘ ফিশার প্রমুখ লোকসাহিত্যে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেন।

ঙ) জাতীয়তাবাদী পদ্ধতি : জার্মানিতে অ্যাডল্ফ হিটলার এই পদ্ধতির জনক। পরবর্তীকালে জাপানেও এই পদ্ধতি খুব জনপ্রিয় হয়, জাপানে জার্মানি লোকসংস্কৃতিবিদ ইয়ানাগিত এই পদ্ধতির প্রধান প্রবক্তা।

চ) নৃবিজ্ঞানগত পদ্ধতি : এই পদ্ধতির পথিকৃৎ হলেন ফ্রানজ বোয়াজ নামে এক জার্মান-আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী । ছ) রাপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি : সাম্প্রতিককালে লোকসংস্কৃতি আলোচনায় সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও বিতর্কিত পদ্ধতি এটি। সোবিয়েত ইউনিয়নের লোকসংস্কৃতিবিদ ভ্লাদিমির প্রপ এই পদ্ধতির জন্মদাতা। পরবর্তীকালে ফরাসী নৃবিজ্ঞানী ক্লাদ লোভি-স্ট্রস (নোয়াম চমস্কি, অ্যালান ভানডেস প্রমুখ) এই পদ্ধতিকে আরো বিকশিত করেন। মোটিফ শব্দটি তিনি ব্যবহার করলেও টাইপ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেননি, করেছেন ‘জাত’ বা ‘শ্ৰেণী' শব্দটি। প্রথম গল্পটিকে তিনি বলেছেন ‘বুদ্ধিদীপ্ত হাসিখুশি’ শ্রেণির। দ্বিতীয় গল্পটিকে তিনি বলেছেন ‘ভয়ভক্তি-দৈবশক্তি’  শ্রেণির এবং তৃতীয় গল্পটিকে তিনি ‘সরলচিত্তের দৈবপ্রসন্নতা' শ্রেণিভুক্ত করেছেন। তিনটি ভিন্ন উৎসের এবং ভিন্ন ‘জাতের’ গল্প নিয়ে তিনি গল্প তিনটির মিল দেখিয়েছেন কতগুলি ‘মোটিফ্’ এর সাহায্যে। ‘ক’ ও ‘খ’ গল্পে তিনি যে মোটিফগুলির মিল পেয়েছেন, সেগুলি—

১. মৌনতা

২. দুষ্টশক্তিসম্পন্ন শয্যাধার

৩. দুষ্টশক্তির অস্তিত্ব

৪. মুখ খোলার মধ্যে সমস্যার সমাধান

৫. অসমসাহসী পাত্র ।