• রামমোহন রায় কেন “লোকপূজিত ধর্মগুরু” রূপে গণ্য হন নি?

  • “রক্ষয়িত্রী শক্তি অর্থে নিছক গোঁড়ামি নয়”—এই কথার তাৎপর্য কী ?

  • বাঙালির “পূর্ণ সার্থকতা” কোথায় নিহিত?

  • ১৮৬০ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত কার “জীবন ধীরমন্থর গতিতে” চলেছিল ?


বাঙ্গালীর সংস্কৃতিতে ও সাহিত্যে, ইংরেজের সহিত সাহচর্য্যের ফলে, আর একবার যুগান্তর উপস্থিত হইল।ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া এখন পর্যন্ত, এই যুগান্তর ব্যাপারে আমরা চারিটি পর্যায় বা ক্রম দেখিতে পাই। 

[১] রামমোহন যুগ, 

[২] “ইয়ং-বেঙ্গল”-এর যুগ, 

[৩] বঙ্কিম-ভূদেব-বিবেকানন্দ যুগ, ও 

[৪] অতি আধুনিক যুগ, বা লড়াইয়ের পরের যুগ।

[১] প্রথম পরিচয়ের যুগে ইউরোপীয় মনের সহিত বাঙ্গালী মনের প্রথম পরিচয়। এই প্রথম পরিচয়ের সময়ে, ভারতের প্রাচীন শিক্ষায় সুশিক্ষিত মন একটু সাবধানতা অবলম্বন করিতে চাহিয়াছিল, একেবারে নিজেকে বিকাইয়া দিতে চাহে নাই। রামমোহন এই যুগের প্রতীক। ইনি অসাধারণ-মনীষাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তখনকার দিনের সামাজিক জীবন ও নৈতিক আদর্শের ঊর্ধ্বে উঠিতে না পারিলেও, ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের সার কথা উপনিষৎকে আশ্রয় করিয়া তিনি ইউরোপের চিন্তার সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন। কিন্তু ভারতের সভ্যতা যে একটা dynamic বা গতিশীল ব্যাপার, উপনিষদেই ইহার পর্যবসান নহে,—এই বোধ আংশিক ভাবে রামমোহনের ও পরে তাঁহার বহু অনুগামীদের মনে না থাকায়, রামমোহনের প্রস্তাবিত সমাধান বা সামঞ্জস্য একদেশদর্শী রহিয়া গেল; এবং বৈরাগ্য-যুক্ত চিত্তের মানুষ না হওয়ায়, রামমোহন এ দেশের মন যাহা চায়—তদনুরূপ ঈশ্বরে একান্তভাবে নিমজ্জিত লোকপূজিত ধর্মগুরু হইতে পারিলেন না ।

[২] দ্বিতীয় যুগে, বাঙ্গালী যুবকদের মধ্যে কতকগুলি অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী ব্যক্তি, প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার সহিত পরিচয়ের অভাবে, ইহার প্রতি আস্থাহীন হইয়া পড়িলেন, এবং তাঁহারা নানা উপায়ে ইউরোপীয় মনোভাব—এমন কি ইউরোপীয় রীতিনীতি ও জীবন-যাত্রার প্রণালী—সমস্ত-ই ভারতবর্ষের উপর আরোপ করিতে চাহিলেন। এরূপ উলট-পালট করিবার মতো সংখ্যা বা শক্তি তাঁহাদের ছিল না; কিন্তু ইংরেজি-শিক্ষিত অথবা ইংরেজি-শিক্ষাকারী জনগণের মনে তাঁহারা একটি ছাপ দিয়া গেলেন।

[৩] তারপরে আসিল যথার্থ সাংস্কৃতিক সমন্বয়-সাধনের চেষ্টা—এই চেষ্টায় ছিল—প্রাচীন ভারতের যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ তাহাকে রক্ষা করিয়া, ইউরোপীয় সংস্কৃতির যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ ও আমাদের পক্ষে হিতকর তাহা আত্মসাৎ করা। বঙ্কিম, ভুদেব ও বিবেকানন্দের যুগে—অর্থাৎ মোটামুটি ১৮৬০ হইতে ১৯০০ পর্যন্ত—জীবন ধীরমন্থর গতিতে চলিতেছিল; ইউরোপীয় সভ্যতা আজকালকার মতো এতটা সর্বগ্রাসী ভাবে আমাদের সমক্ষে তখন দেখা দেয় নাই, আমাদের জীবনে আজকালকার মতো এত জটিল অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাও আসে নাই। তখন ভাবিয়া- চিন্তিয়া ধীরে সুস্থে বিচার করিবার অবকাশ ছিল, তাই আমরা বঙ্কিমে ভূদেবে বিবেকানন্দে বাঙালী জাতির পক্ষে হিতকর—তাহার সংহতি-শক্তিকে দৃঢ় করিবার উপযোগী এবং তাহাকে আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করিবার যোগ্য—কথা পাই; সমীক্ষা ও অনুশীলন ছিল বলিয়াই বঙ্কিম ও মধুসূদন বাঙ্গালীর জন্য এমন চিরন্তন রস-সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন যাহা বাঙ্গালীর সাহিত্যে অমর হইয়া থাকিবে। বাঙ্গালী ভাব-প্রবণ জাতি, ইহা সত্য বটে,—কিন্তু এই ভাব-প্রবণতাই তাহার পূর্ণ পরিচয় নহে । বাঙ্গালী লক্ষণীয় সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়াছে; কিন্তু সেই সাহিত্য, জগতে এমন অপূর্ব কিছু বস্তু নহে;—তাহার প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে গোটা পঞ্চাশেক কি শতখানেক বৈস্মব পদ এবং কতকগুলি আখ্যায়িকা, এবং আধুনিক সাহিত্যের মধ্যে কতকটা মধূসূদনের কাব্যাংশ, বঙ্কিমের খানকয়েক উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধ ও অন্য রচনা—মাত্র এই কয়টি জিনিস আমরা বিশ্বসাহিত্যের দরবারে উপস্থাপিত করিতে পারি। ভাটিয়া বা মারোয়াড়ী, অথবা পাঞ্জাবী বা হিন্দুস্থানীর তুলনায় বাঙ্গালী ব্যবসায়-বাণিজ্যে তেমন সুবিধা করিতে পারিতেছে না; ইহার কারণ নির্দেশ করিবার জন্য অমনিই সিদ্ধান্ত করা হইল, বাঙ্গালী কবি জাতি, ভাব-প্রবণ জাতি তাহার মধ্যে কর্মশক্তি নাই, তাহার উৎসাহ ও উদ্যোগের সমস্তটাই ভাবুকের খেয়ালে, কবির কল্পনায় নিঃশেষিত হইয়া যায়। আমরাও এই কথাটা যেন পাকে-প্রকারে মানিয়া লইয়াছি; রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর হইতে, আমাদের সাহিত্যের সম্বন্ধে বেশ সচেতন গৌরব-বোধ আমাদের মধ্যে জাগিয়া উঠিয়াছে, একটা গর্ব-সুখে আমাদের চিত্ত ভরিয়া গিয়াছে। আমাদের বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্' গান কার্য্যতঃ ভারতবর্ষের রাষ্ট্র-সংগীত রূপে গৃহীত হইয়া গিয়াছে। প্রত্যেক সমাজের মধ্যে দুই প্রকারের কার্য্য করে—কেন্দ্রাভিমুখী ও কেন্দ্রাপসারী, আত্মসমাহিতকারী এবং আত্মপ্রসারকারী; এই দুইয়ের সামঞ্জস্যে সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হয়। কবিত্ব ও কল্পনাশক্তির অনুপ্রেরণায় বাঙ্গালী সম্প্রতি একটু বেশি রকম করিয়া বর্হিমুখী হইতে চাহিতেছে। ইংরেজদের সঙ্গে বাঙ্গালির সাহচর্য্যে বাংলা সংস্কৃতিতে যে যুগান্তর আসে, তা এখনও চলছে। এই যুগান্তরের চারিটি পর্য্যায় বা ক্রম দেখা যায়—

(১) রামমোহন যুগ—ইউরোপীয় মনের সঙ্গে বাঙালি মনের প্রথম পরিচয়ের সময় প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। রামমোহন এই যুগের প্রতীক, তিনি উপনিষদের সঙ্গে ইউরোপীয় চিন্তার সামঞ্জস্য সাধন করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় সমাজের গতিশীলতার বোধটি না থাকায় এই সামঞ্জস্য ঠিক পথ পেল না। তিনি নিজেও ব্যক্তিজীবনে বৈরাগ্যযুক্ত না হওয়ায় লোকপূজিত ধর্মগুরু হতে পারেন নি।

(২) ইয়ং-বেল এর যুগ—দ্বিতীয় যুগে কিছু তীক্ষ্ণধী বাঙালি যুবক প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার সঙ্গে অপরিচয়ের ফলে এর প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে। তারা নানাভাবে ইউরোপীয় রীতিনীতি জীবনযাত্রার প্রণালী ভারতবর্ষের ওপর আরোপ করতে চাইল। একাজে তারা সাফল্য না পেলেও এখানকার ইংরেজী শিক্ষিত বা শিক্ষাকামী জনগনের মনে তারা একটা ছাপ রাখতে পেরেছিল।

(৩) বঙ্কিম-ভূদেব-বিবেকানন্দ যুগ—এই যুগে (১৮৬০-১৯০০) প্রাচীন ভারতের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তার সঙ্গে ইউরোপীয় সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ জিনিসের মিশ্রণে যথার্থ সাংস্কৃতিক সমন্বয়সাধনের চেষ্টা হয়েছিল। ইউরোপীয় সভ্যতা তখনও এত সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠেনি। ফলে সে সময়ে বঙ্কিম-ভূদেব-বিবেকানন্দে বাঙালির পক্ষে হিতকর, আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধকর কথা পাওয়া যায়। সমীক্ষা ও অনুশীলন ছিল বলেই বঙ্কিম-মধুসূদন বাঙালির জন্য চিরন্তন রস সৃষ্টি

করতে পেরেছেন ।

(৪) অতি আধুনিক যুগ বা লড়াইয়ের পরের যুগ—এই যুগের মূল কথা, বাঙালির জীবনে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রচন্ড আঘাত, বাঙালির জীবনে ক্রমবর্ধনশীল অর্থনৈতিক অবনতি ও তার আনুষঙ্গিক মানসিক ও নৈতিক অবনমন এবং আদর্শ-বিপর্যয়। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ও এই আর্থিক অবনতির এক প্রধান কারণ, অর্থনৈতিক সংকট বাঙালির সামাজিক আদর্শকেও প্রভাবিত করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রাবন্ধিক যখন এ প্রবন্ধ রচনা করছেন তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু যে কারণে বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল অর্থাৎ সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক বাজারকে বিশ্বের কোন্ শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে, বাজারের ভাগ বাটোয়ারায় পুঁজিবাদী বৃহৎ শক্তিগুলির বিন্যাস কি দাঁড়াবে তার সমাধা হয়নি। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল বিশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের প্রথম থেকেই। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল সারা পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট, Economic Depression নামে যা পরিচিত। যাকে সামাল দিতে গিয়ে বিশ্ব নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্বের জন্ম হ'ল কেইনসীয় অর্থনীতি। এই অর্থনৈতিক সঙ্কট বিশ্বসংকটের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এসে পড়েছিল। এর সাথে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে যুক্ত হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম সমস্যা। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি আস্থা না রাখতে পারায় মুসলিমরা বিচ্ছিন্ন হতে চাইছিল। এর কিছু যথার্থ কারণও আজ ঐতিহাসিক-গবেষকরা নির্ণয় করেছেন। তাঁদের মতে, ভারতীয় জাতীয়তার নামে উনিশ শতাব্দীতে যা তৈরি হচ্ছিল তা আসলে বর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদ। জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের বিষয় এবং ভাষাতেও তা ফুটে উঠেছিল।প্রাবন্ধিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর এই বিষয়নিষ্ঠ প্রবন্ধে সমাজমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সাধু ও চলিত উভয় গদ্যরীতিতে প্রবন্ধ রচনা করলেও নির্বাচিত প্রবন্ধের গদ্যরীতি সাধুবাংলা। এখানে তিনি মূলতঃ একাধিক কমা বা সেমিকোলন দিয়ে বাক্য সাজিয়েছেন। তবে তাঁর এ প্রবন্ধে যুক্তিপরম্পরা ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দেখা যায়। এছাড়াও তাঁর ‘জাতি সংস্কৃতি ও সাহিত্য' প্রবন্ধে আমরা একজন ইতিহাসমনস্ক প্রাবন্ধিককেও

পাই ।