• ‘সংস্কৃতির সংজ্ঞা’ প্রবন্ধটির গঠনসৌকর্য ও ভাষা প্রয়োগ সম্বন্ধে আলোচনা করুন ?

  • সংস্কৃতি বলতে গোপাল হালদার কী বুঝিয়েছেন? তাঁর প্রদত্ত সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করুন?


বিশ শতকের প্রথমার্ধে ‘সবুজ পত্র’ (১৯১৪-১৯২৮) এবং ‘কল্লোল’-এ পরিবর্তনের ভূমিকা রচনা করেছিল। বিশেষত ‘সবুজ পত্র’ ইউরোপীয় সাহিত্যের মননসমৃদ্ধির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাঙালি মন হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক। রুশ বিপ্লব তার মনোভুবনকে নাড়া দিয়েছিল।এই পটভূমিতে বিশ শতকে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে দেখা দিল মোটামুটি দুটি প্রবণতা—

(ক) সাহিত্য ও সাহিত্যিক সম্পর্কিত প্রবন্ধ রচনা, 

(খ) মননপ্রধান পাশ্চাত্য-চিন্তন প্রভাবিত প্রবন্ধ। তার সঙ্গে ছিল আত্মগত নিবন্ধ বা রম্য রচনার পূর্বগত ধারা। সেধারাটিও বিশ শতকের তিরিশের দশকে পুষ্ট হয়েছিল।

(ক) সাহিত্য-সাহিত্যিক সংক্রান্ত প্রবন্ধ—এ ধারার প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আছেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত, মুহদ শহীদুল্লাহ্, মোহিতলাল মজুমদার, সুশীলকুমার দে, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, প্রমথনাথ বিশী, অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু।

(খ) মননপ্রধান পাশ্চাত্য-চিন্তন প্রভাবিত সমকাল-সচেতন প্রবন্ধ ধারা—কাজী আবদুল ওদুদ এই ধারার প্রাবন্ধিক। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ রায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, রেজাউল করীম, সৈয়দ মুজতবা আলী, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিনয়কুমার সরকার, আবু সয়ীদ আইয়ুব, বিষ্ণু দে, বিনয় ঘোষ প্রমুখ বিশিষ্ট বুদ্ধিপ্রধান লেখক এই ধারার প্রাবন্ধিক।

দুই ধারার প্রাবন্ধিকদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ও কাজী আবদুল ওদুদ পাঠক্রমভুক্ত প্রাবন্ধিক হওয়ায় তাঁদের সম্বন্ধে পৃথক আলোচনা করা হয়নি।‘সংস্কৃতির সংজ্ঞা’ কোনো পৃথক গ্রন্থ নয়। ‘সংস্কৃতির রূপান্তর' নামে গোপাল হালদারের একটি গ্রন্থ ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রিত হয়ে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল বাংলার সংস্কৃতি জগতে। সেই গ্রন্থটির ‘সংস্কৃতি জিজ্ঞাসা' নামক প্রথম ভাগ ‘সংস্কৃতির সংজ্ঞা' নামে পাঠসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।গোপাল হালদার সৃষ্টিশীল মনের অধিকারী। মানবতায় ছিল তাঁর দৃঢ় আস্থা। কমিউনিজম তাঁর কাছে ছিল মানবতার এক নামান্তর। বিদগ্ধ এই মনীষী সংস্কৃতি নিয়ে কোনো গম্ভভীর গবেষণা করেননি। তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদীর দৃষ্টিতে সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তত্ত্ব তাঁর প্রবন্ধকে ভারাক্রান্ত করেনি। তাঁর প্রবন্ধ মানবজাতির পরিবর্তমান আত্মপরিচয় ও আত্মানুসন্ধানের দলিল। গোপাল হালদার ইতিহাস সচেতন মনোভাব নিয়ে সংস্কৃতির সংজ্ঞাটিকে চিনে নিতে চেয়েছেন। তার সঙ্গে অন্বিত হয়েছে গভীর মানবপ্রীতি। তাই ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’-এর ‘কথারম্ভ’-এর পরিচ্ছেদ শেষে পাই—‘সংস্কৃতির অর্থ শুধু সংস্কারের পুনরাবর্তন নয়, সংস্কারের ঐতিহাসিক বিবর্তন। সমস্ত বিবর্তনের মধ্য দিয়া মানুষ ক্রমেই বেশী করিয়া মানুষ হইতেছে, প্রাচীন সংস্কৃতিও হইতেছে এক ব্যাপকতর বিশ্বসংস্কৃতির রূপান্তর।” গোপাল হালদারের ‘সংস্কৃতির রূপান্তর' তিন খণ্ডে বিভক্ত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এই গ্রন্থের ‘সংস্কৃতি-জিজ্ঞাসা’ নামের প্রথম ভাগের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘সংস্কৃতির গোড়ার কথা' পাঠ্য হিসেবে নির্দিষ্ট। তার পূর্বে ‘কথামুখ” নামের প্রথম অধ্যায়ে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে কমিউনিজম-এর মানবতা-পোষক দিকগুলি বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণের মধ্যে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ত্রুটিগুলিও তিনি দেখিয়েছেন—যা তাঁর সমদর্শী মনের পরিচায়ক।সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা শিক্ষা ও সংস্কৃতির সর্বজনীন বিকাশ ঘটাতে পেরেছে; প্রতি মানুষের স্বাধীন সত্তার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব করেছে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থাই আর্থিক পরিকল্পনার সাহায্যে মানুষকে আপন উন্নতি সাধনের দায় ও দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে দিয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত সমাজবিন্যাস ও বিজ্ঞানের সুষম বিকাশে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের সদ্বব্যবহার দ্বারা মানব-উন্নতির কর্মে পথপ্রদর্শক হয়েছে। গৃহযুদ্ধ, বিদেশি আক্রমণ, অর্থসংকট, বণিকতন্ত্রের ষড়যন্ত্র, ফ্যাসিজম্-এর আক্রমণ, নিজেদের ভুল—এসব সত্ত্বেও সোভিয়েত রাষ্ট্রের উন্নতি রুদ্ধ হয়নি। তাই গোপাল হালদার বুঝেছিলেন কমিউনিজম চালিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষের সামগ্রিক বিকাশ সম্ভব। তাঁর মতে ‘সর্বাঙ্গীণ বিজ্ঞানের সাধনা' আর ‘সার্বজনীন মানবতার সাধনা'—এই দুটিতেই সোভিয়েত সংস্কৃতির আসল পরিচয় প্রকাশিত। বিপ্লবের সর্বকালীন বাণী ‘আই কাম টু ফুলফিল, নট টু ডেস্ট্রয়’ (‘I come to fulfil, not to destroy')। ‘বিজ্ঞান ও বিশ্ববিপ্লব’ পরিচ্ছেদে গোপাল হালদার বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞান কেমন করে হয়ে উঠেছে মানবমুক্তির সহায়ক। বিদ্যুৎ ও পেট্রল আবিষ্কার, অ্যাটমিক শক্তির আবিষ্কার ক্রমে মানুষকে শ্রমনির্ভরতা থেকে দিয়েছে মুক্তি। ফলে মানুষের চিন্তাজগৎ হয়েছে সমৃদ্ধ। উন্নত চিন্তার প্রভাবে শোষিত মানব শোষক শ্রেণির স্বরূপ বুঝতে পেরেছে, খুঁজে পেয়েছে সংগ্রামের পথ। আবার পারমাণবিক শক্তির প্রসারের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর সোভিয়েত শক্তির অ্যাটমিক শক্তিলাভ) ফলে যুদ্ধ প্রবণতা সংকুচিত হয়েছে। তাই বলা যায় বিজ্ঞান এনেছে বিপ্লব। যার ফলে মানুষের জাতিগত একাধিপত্য চূর্ণ হবে ; কোনো বিশেষ জাতির স্বার্থে মানবজাতির ধ্বংস হবে না।

বাংলায় ‘কালচার’ অর্থে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়। ‘কৃষ্টি’—শব্দটির বৈদিক অর্থ সমুদয় কৃষকদল। সেটিও ‘কালচার’-এর প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়েছিল কিছুকাল। ব্যবহারটি ভুল ছিল না। তথাপি ‘কালচার’ অর্থে আর এক বৈদিক শব্দ সংস্কৃতিই অধিক প্রচলিত। কারণ শব্দটির মধ্যে মানুষের কৃতির বা সৃষ্টিমূলক প্রচেষ্টার ইঙ্গিত আছে। সংস্কৃতি মনের বিনাশ, বা কেবলমাত্র মানসসম্পদ নয়। মানুষের জীবনের বাস্তব প্রয়োজনে তার উদ্ভব। সংস্কৃতি থেকে মানুষ পায় জীবন-সংগ্রামের শক্তি। জীবনের বাস্তব উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্যই তার আবির্ভাব। আবার জীবনযাত্রার ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে সংস্কৃতির প্রকৃতি পালটে যায়। সংস্কৃতি জীবনের পরিবর্তনের সহায়ক। সেই পরিবর্তনের ফলে সংস্কৃতিরও ঘটে পরিবর্তন। অর্থাৎ সংস্কৃতির সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। তাই সে সচল এবং পরিবর্তনশীল তার রূপ।

সংস্কৃতির পরিবর্তনের নিয়ম এবং সংস্কৃতির মূল তত্ত্ব কাকে বলে—তা জানা সংস্কৃতি আলোচনার অন্যতম ভিত্তি। এই সংস্কৃতির মূল অঙ্গ তিনটি—

(১) জীবন সংগ্রামের বাস্তব উপকরণ সমষ্টি (material means), 

(২) সমাজের বাস্তব গঠন (Social Structure) এবং 

(৩) মানস-সম্পদ। সবার উপরে এই মানস-সম্পদের অবস্থান বলে তার নাম Superstructure |

সংস্কৃতিকে দেশগত, জাতিগত ও ধর্মগত বলা এবং সাহিত্য, চারুশিল্প, কারুশিল্প, দর্শন-বিজ্ঞানকে সংস্কৃতি সংজ্ঞা দেওয়া—উভয়ই আংশিক সত্য। সংস্কৃতি সমাজ-দেহের সমগ্র রূপ; তাকে সমাজের লাবণ্য বলা যায় না কোনো মতেই।

সমাজের পরিচয়েই সংস্কৃতির পরিচয়। আবার সমাজ-পরিচয় নিহিত তার জীবন-ধারণের উপাদান সমূহের (means of living) উপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রস্তর যুগের মানুষের জীবন-প্রয়াস ছিল সমবেত শক্তির মধ্যে নিহিত। কারণ তখন মানুষের জীবন-ধারণের উৎস ছিল পাথরের অস্ত্র দিয়ে পশু শিকার। সমবেত শ্রম ভিন্ন তা সম্ভভব ছিল না। তাই এ সমাজ ছিল সম্মেলক সমাজ।সংস্কৃতির রূপায়নের প্রথমটিকে তাই বলা যায় জীবন-ধারণের উপকরণ নির্ভরতা। প্রস্তর যুগের মানুষ পারস্পরিক সংযোগ-স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলেছিল ভাষা। ব্যবহৃত উপকরণকে সুন্দর করে তোলার প্রয়াসও তার ছিল। এই দ্বিবিধ উপকরণ দিয়েই গড়ে উঠেছিল তার সমাজ। জাতিধর্ম নয় মানুষ আর তার জীবনোপকরণ দিয়েই সমাজ গড়ে ওঠে। সেভাবে সমাজের নামকরণ বিজ্ঞানের বিচারে সঠিক নামকরণ। সংস্কৃতির দ্বিতীয় অঙ্গ সামাজিক রূপ; তথা ব্যবহৃত উপকরণ দ্বারা সেই সময়ের মানসিক রূপ চিনে নেওয়ার পদ্ধতি। যেমন প্রস্তর যুগের মানুষের মন ক্ষুধা ও ক্ষুধাতৃপ্তির উপায় নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তাই এ সমাজে ভাষার ও সৌন্দর্যচর্চার (ব্যবহৃত উপকরণগুলির সৌকর্য সাধনপ্রয়াস) সম্যক বিকাশ হয়নি। এ সমাজ ছিল সমষ্টিগত শ্রমের সমাজ। তাদের মানস-রূপের পরিচয় মেলে সমাধিতে দেওয়া জীবনোপকরণ থেকে। বোঝা যায় মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ধারণা তার মনে দানা বাঁধছিল। এর পরে এল কৃষিযুগ। তখন নদী, ঋতু, আবহ নিয়ে তার মানস জগৎ গড়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে এসেছিল জমির মালিকানা সংক্রান্ত চিন্তা। এভাবেই সমষ্টিগত জীবন-সংস্কৃতি ভেঙে গিয়ে গড়ে উঠেছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন সংস্কৃতি। কিন্তু এই মূল স্তরের মধ্যে ছিল জমির মাপ, নদী, মেঘকে তুষ্ট করা ফসল অনিষ্ট রোধ করার জন্য নানা বিদ্যা ও প্রক্রিয়ার চর্চার স্তর। সংস্কৃতির শেষ অবয়ব মানসসম্পদ। যখন জীবিকা-প্ৰয়াস কিছুটা সহজ হয়েছে তখনই এসেছে মানসসম্পদের বিকাশের কাল। আদিম স্তরে এই মানসসম্পদের সঙ্গে জীবিকার যোগ ছিল দৃঢ়। তাই পশুপালক জাতির গীতবাদ্য- নৃত্যাদির সঙ্গে মিল ছিল না কৃষিজীবী জাতির গান, নাচ, সাহিত্য, বিজ্ঞান চর্চার। মানস-প্রয়াস তাদের জীবিকা-প্রয়াসকে করেছিল পুষ্ট আর শক্তিমান—তাদের সংস্কৃতি পেয়েছিল পূর্ণতা।মানুষের জীবিকানির্বাহ-পদ্ধতি এ গাছের মূল; সমাজ তার কাণ্ড ও শাখাপ্রশাখা আর সাহিত্য, শিল্প, অভিনয়, নৃত্য, গীত, বাদ্য, দর্শন, বিজ্ঞান—এই সব মানসসম্পদ এ বৃক্ষের ফুল ও ফল। ফুল-ফল ভিন্ন বৃক্ষ সার্থক নয় ; আবার মূল, কাণ্ড ব্যতীত ফল-ফুলের অস্তিত্ব অসম্ভব। এই তিনের সুষম মিলনেই গড়ে ওঠে সংস্কৃতি। সমাজদেহের প্রতি অঙ্গের পারস্পরিক যোগ গভীর ও সক্রিয়। এবং তাদের সম্মিলিত গতিশীল রূপ সংস্কৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে মানুষের জয়লাভের অস্ত্র সংস্কৃতি। আবার তার সেই যুদ্ধে জয়ের নিদর্শনও সংস্কৃতি। সংস্কৃতির যথার্থ স্বরূপ ও সংজ্ঞা এই সত্যের মধ্যেই নিহিত। এভাবে গোপাল হালদার তাত্ত্বিক মার্কসবাদের সুষ্ঠু প্রয়োগে বিশ্লেষণ করেছেন সংস্কৃতির; রূপ নির্ণয় করেছেন তার সংজ্ঞা। এই কঠিন কর্মে তিনি সফল যা তাঁর গভীর প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়।

‘সংস্কৃতি’ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় ‘কালচার’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে। ‘কালচার’ এর মূল উৎস লাতিন ‘কুলতুরা’ (cultura) শব্দ। লাতিনে শব্দটি এসেছে ‘কোল' (col) ধাতু থেকে—যার অর্থ চাষ করা। ‘কৃষ্’ শব্দটির সাহায্যে সাধারণত মানুষের মার্জিত মানস সম্পদ—সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, চিত্র প্রভৃতি বোঝায়। আমরা মনে করতে পারি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রদত্ত সংস্কৃতির সংজ্ঞাটি—যা আছে তাঁর ‘সংস্কৃতি শিল্প ইতিহাস’ গ্রন্থের ‘সংস্কৃতি’ অধ্যায়ে (পৃ. ৬)। সংজ্ঞাটি এই “ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি, সুসংবদ্ধ জীবন-রীতি—প্রভৃতির অতিরিক্ত আর একটা কিছু জাতির জীবনে পাওয়া যায়, যেটা তার বাহ্য সভ্যতার ভিতরের ব্যাপার রূপে প্রতিভাত হয়। সেটা একদিকে তার বাইরের সভ্যতার আভ্যন্তর প্রাণ বা অনুপ্রেরণা বটে, আর একদিকে তার বাহ্য সভ্যতার প্রকাশও বটে। সভ্যতার এই আভ্যন্তর অথচ বাইরেও প্রকাশমান এই অতিরিক্ত বস্তুটিই কালচার বা সংস্কৃতি।” গোপাল হালদার সংস্কৃতিকে কেবলই ‘আভ্যন্তর প্রাণ' বা সভ্যতার বাইরের রূপ বলে গ্রহণ করেননি। তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে সংস্কৃতির বিচার করেছে। ক্রিয়া এবং তার বিপরীত ক্রিয়ার দ্বন্দ্ব—সব কিছুর মূল—একেই সংক্ষেপে বলা যায় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া—উভয়ের দ্বন্দ্ব এবং তার ফলে নতুনের আবির্ভাব। আবার এই নতুনের মধ্যে দেখা দেয় বিরোধ এবং তার সাময়িক বিনাশও ঘটে। দেখা দেয় নতুনতর রূপ। অবিচ্ছিন্ন চলে এই প্রক্রিয়া। এরই নাম দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বা ‘ডায়লেকটিকাল মেটিরিয়ালিজম্'। যখন ইতিহাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় তখন তা হয় হিস্টরিক্যাল মেটিরিয়ালিজম—ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

গোপাল হালদার সংস্কৃতিকে মানস-বিলাস বলেননি। তাঁর মতে সংস্কৃতি মনের সৃষ্টিসম্পদ মাত্র নয়; তার উদ্ভদ বস্তুজগতের প্রয়োজনে। মানুষ টিকে থাকার সংগ্রামে শক্তি পায় সংস্কৃতি থেকে, আবার জীবনের উৎসও সংস্কৃতি। জীবনযাত্রার সংঘাতে-আঘাতে সংস্কৃতির বাইরের রূপ ও অন্তরের ভাব পালটে যায়। জীবনযাপনের সহায়ক বলেই জীবনযাত্রার উন্নতির সঙ্গে সংস্কৃতিরও হয় মানোন্নয়ন । এভাবেই উপকরণের প্রয়োগ-ভিন্নতা দ্বারা সংস্কৃতির রূপ গড়ে ওঠে। অর্থাৎ সমাজবিন্যাস হয়ে ওঠে সংস্কৃতির আশ্রয় ৷